নিয়ম, অনিয়ম, এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি: সভ্যতার মূল বাধা

 ধর্মীয় গোঁড়ামি ইতিহাসে বারবার সভ্যতার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং প্রযুক্তির উন্নতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ আলোচনা করা হলো।

১. মধ্যযুগের ইউরোপ এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি

পটভূমি

মধ্যযুগের ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চ ছিল সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। চার্চের মতবাদের বিরুদ্ধে কোনো মত প্রকাশ করাটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে সংঘাতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উদাহরণ হলো গ্যালিলিও গ্যালিলির ঘটনা।

উদাহরণ

গ্যালিলিও গ্যালিলি তার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করেন যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে (হেলিওসেন্ট্রিক মডেল), যা কোপার্নিকাস প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চ এই মতবাদকে বিরোধিতা করে এবং গ্যালিলিওকে তার মতবাদ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করে। গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হয় এবং তার গবেষণা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। এই ঘটনা বিজ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চার ওপর ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ।

২. গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং কুসংস্কার

মধ্যযুগীয় ইউরোপে চার্চের কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানচর্চাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

৩. রেনেসাঁস এবং জ্ঞানচর্চা

রেনেসাঁসের সময় ইউরোপে জ্ঞান এবং শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল, যার মধ্যে বিজ্ঞান, শিল্প, এবং সাহিত্য নতুন মাত্রা পায়। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার এই জ্ঞানচর্চার অগ্রগতিকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছিল।

৪. উইলিয়াম হার্ভে এবং রক্ত সঞ্চালন

উইলিয়াম হার্ভে তার রক্ত সঞ্চালনের তত্ত্ব প্রস্তাব করলে তার ধারণা চার্চের বিরোধিতার মুখে পড়েছিল। তৎকালীন চার্চ বিশ্বাস করত যে হার্ভের ধারণা বাইবেলের শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৫. ভারতের জাতপাত ব্যবস্থা

পটভূমি

ভারতে ধর্মীয় গোঁড়ামি দীর্ঘদিন ধরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে জাতপাত ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই ব্যবস্থা মানুষের অধিকার এবং সুযোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করেছিল।

উদাহরণ

ভারতের জাতপাত ব্যবস্থার মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র চারটি প্রধান বর্ণের মধ্যে বিভাজন ছিল। শূদ্ররা এবং তথাকথিত 'অস্পৃশ্য'রা সমাজের নিম্নতম স্তরে অবস্থান করত এবং তাদের প্রতি বৈষম্য ও অবমাননা করা হতো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মহাত্মা গান্ধী এবং বি.আর. আম্বেদকরের মতো নেতারা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধান জাতপাত ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে।

৬. সালেমের ডাইনী বিচারের মামলা

পটভূমি

১৬৯২ সালে ম্যাসাচুসেটসের সালেমে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে ডাইনী বিচারের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় চার্চ এবং সম্প্রদায়ের নেতারা ডাইনী সন্দেহে অনেক মহিলাকে অভিযুক্ত করে এবং তাদের উপর অত্যাচার চালানো হয়।

উদাহরণ

সালেমের ডাইনী বিচারের ফলে অনেক নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পায় এবং মৃত্যুবরণ করে। এই ঘটনা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রভাবের একটি চরম উদাহরণ। এ ধরনের ধর্মীয় কুসংস্কার সমাজে ভীতি এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে।

৭. ইসলামী স্বর্ণযুগ এবং আধুনিক যুগের গোঁড়ামি

পটভূমি

৮ম থেকে ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এই সময়ে মুসলিম বিজ্ঞানী এবং পণ্ডিতরা জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।

উদাহরণ

ইবনে সিনা (আভিসেনা) এবং ইবনে রুশদ (আভেরোয়েস) এর মতো বিজ্ঞানীরা চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন এবং বিজ্ঞান ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। তবে, আধুনিক যুগে কিছু অঞ্চলে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কট্টরপন্থা আবারো জ্ঞানচর্চা এবং সমাজের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার সীমিত করা হয়েছিল।

উপসংহার

ধর্মীয় গোঁড়ামি সভ্যতার অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনো করছে। এটি জ্ঞানচর্চা, মানবাধিকার, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তবে, ইতিহাস দেখিয়েছে যে মানুষ পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রভাব কমিয়ে এনে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। শিক্ষা, সচেতনতা, এবং মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত এবং প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশের ইতিহাস দুই চার কথায়

গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান ও আন্দোলনের পটভূমি