অর্গাজম
গ ল্প ৩
অর্গাজম
কাবেরী রায়চৌধুরী, অলঙ্করণঃ স্বপন কুমার চন্দ
শীত আসবো আসবো সময়। পরিপাটি
হয়ে বসলেন এসে টেরেসের বেতের সোফায়। দার্জিলিং টি পানের অভ্যাস এই সময় প্রতিদিন।
সহায়িকা মেয়েটি টি-পটে গরম জল, চা-পাতা ছাঁকনি, পোর্সেলিনের পেয়ালা-পিরিচ সব সাজিয়ে দিয়ে গেল। বললো, আজ কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজনও এলোনা দিদি! চা ছাঁকতে ছাঁকতে তিনি ঘাড়
নাড়লেন মাত্র।
-- কালকের যে মেয়েটা এসেছিল আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে। বলতে বলতে
আকাশের দিকেই ফিরে চাইলো সে।
-- তুই চা খেয়িছস দীপা? তোর চা কই?
-- আজ খাব না গো। ভাল্লাগছে না। শরীলটা? ম্যাচম্যাচ? করছে। বমি বমি পাচ্ছে।
-- অম্বল হল? একটু জোয়ান আমলকি মুখে দে।
গ্যাস হলেও চলে যাবে।
মাথা নাড়ল দীপা। আকাশটা দেখলে
কেমন মন ভালো হয়ে যায়, না?
-- হ্যাঁ। আমার মন খারাপ হলেই আকাশ দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।
-- আগে জানতাম না। তোমার কাছে আসার পর বুঝেছি। আচ্ছা, বাচ্চা গর্ভপাত করানো কি পাপ?
চায়ে চুমুক দিতে দিতে চমকে
উঠেছেন বেদবতী। চোখে বিস্ময়। এক মুহূর্ত থমকে গেলেন। বললেন, কেন বল তো? হঠাৎ জিজ্ঞেস করছিস?
-- না, বললাম।
-- তোর কিছু-?
-- যদি হয়, তাই বললাম। আমি রাখবো না।
-- কেন? তোর তো ছিলেপুলে নেই?
-- না। আমি বুঝতে পারি না আমার বরকে আমি ভালোবাসি কী না!
দীপাকে আজ মাস ছয়েক ধরে দেখছেন
বেদবতী। নম্র শান্ত স্বভাব। কম কথা বলে। কাজে রাখার পরে জেনেছিলেন শুধু স্বামী আর
শ্বশুর নিয়ে সংসার তার। সেন্টার থেকে পাঠিয়েছে দীপাকে। এর বেশি খোঁজ নেওয়ার
প্রয়োজনও তিনি বোধ করেননি। তাও গল্পে গল্পে বলেছিল। একটু অবাক হলেন বটে। বললেন, বিয়ের সময় পছন্দ করে দেখিসনি?
-- না। সম্বন্ধ এল। এক ছেলে। নেশা ভাঙ করে না, দেশে জায়গা জমি আছে, এখানে রিস্কা চালায় এই দেখেই
বিয়ে দিয়ে দিল।
-- ও। বর আদর যত্ন করে না তোকে?
-- আমি বুঝতে পারি না!
-- কী? জ্বালাতন! হেসে ফেললেন বেদবতী।
বললেন, বুঝবি আস্তে আস্তে। অত চিন্তা করিস না। বেল বাজছে।
দেখে খুলিস। এখন তো কারুর আসার কথা নয়? অপরিচিত হলে আমায় ডাকবি আগে।
যা।
প্রায় দৌড়েই গেল দীপা। ফিরেও
এল দৌড়েই, ওই গল্প করার লোক গো! মুখটা
আইহোল দিয়ে দেখেছি, চশমা পরা। চোর ডাকাত হবে না।
বললো, পেপারে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি। খুলবো?
-- খোল। এইখানে নিয়ে আয়। নাম জিজ্ঞেস কর।
 
ছ’ ফুটের ওপর লম্বা যে যুবককে নিয়ে টেরেসে এল দীপা তাকে দেখেই প্রাথমিক
একটা আশ্চর্য আবেগ টের পেলেন বেদবতী। কেমন যেন একটা হঠাৎ দখিনের বাতাস ঘোর
গ্রীষ্মে শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন অনুভব!
বেদবতী কিছু বলার আগেই যুবকটি
দু’হাত জোড় করে বললো, নমস্কার!
-- বসো। বসো। নমস্কার। বসো। নিজের হঠাৎ অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে নিয়েছেন
দ্রুত বেদবতী। দীপার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘চা’। ‘আপনি ভাই চা খান তো’ নাকি ‘কফি’?
-- আমাকে তুমি বললেন প্রথমেই ওটাই তো ভাল ছিল! চশমার ওপার থেকে উজ্জ্বল
একজোড়া চোখে আশ্চর্য আবেদন ছেলেটির। আমি আপনার থেকে কত বছরের ছোট জানেন?
বিস্ময় যেন কাটছেন না বেদবতীর, বললেন, কেমন করে জানবো?
-- আমার যখন তেরো ছিল তখন আপনার পঁয়ত্রিশ ছিল! হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন
বেদবতী। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে
ছেলেটি হাসলো; স্মিত, বললো, আমার নাম সান্ধ্যদীপ নন্দী।
-- মানে? মানে, আমি ঠিক...!
-- বুঝতে পারলেন না তো? বোঝার কথাই নয়! আমার মতো
আপনার লক্ষ লক্ষ ফ্যান। আমি আপনাকে যেদিন প্রথম দেখি; দেখি না, সাক্ষাৎ, সাক্ষাৎ বলবো। সেই প্রথম সাক্ষাৎ-এর দিন আমার বয়স ছিল তেরো বছর দু’ মাস একদিন! আপনি আপনার লেখা কাব্যনাটক তিতির প্রতীক্ষা থেকে পাঠ
করছিলেন রবীন্দ্রসদনে! মিউজিক সহ! হল প্রায় ভর্তি। আমাকে নিয়ে মা গিয়েছিল দেখতে
এবং শুনতে। গেস্ট কার্ড ছিল আমাদের। সামনের সারিতে বসে-! যতটা অনাগ্রহ নিয়ে
গিয়েছিলাম ততোটাই মেসমারাইজড! আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলাম। আপনার হাতে দারুণ
একটা গন্ধ!
সূর্য অস্তাচলে গেছে যেন কখন!
পশ্চিম আকাশ-দিগন্ত কমলা-আবীরে স্নাত! সেই আভা বেদবতীর সমগ্র মুখমণ্ডল জুড়ে! কিছু
শুনছেন কী না বোঝা দায়!
-- দিদি! চা! দীপা আরেক দফা গরম জল, চা-পাতা আর কুকিজ দিয়ে গেল।
সম্বিত ফিরে পেয়েছেন বেদবতী, বললেন, হ্যাঁ, রাখ, তুই কি এখন যাচ্ছিস?
-- সময় হয়ে গেছে। এইবার ব্যাগট্যাগ গুছোব। করতে করতেই সাতটা হয়ে যাবে।
তুমি বলো যদি আরেকটু পরে যেতে পারি। চোখের ইশারায় সান্ধ্যদীপকে দেখিয়ে ইঙ্গিত করল, থাকবো?
-- না, তুই যেতে পারিস।
-- যাবার সময় বাবুলালকে বলে যাচ্ছি। বলে ঘরে ঢুকে গেল দীপা।
-- বাবুলাল বুঝি দারোয়ান? হেসে ফেললো সান্ধ্যদীপ। একটু
বুঝি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বেদবতী। বললেন, খুব কেয়ারিং। কথা বললেন বটে
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অদ্ভুত একটা ঝিমধরা ভাব বুঝতে পারছেন।
-- আমি বানাবো চা-টা? আপনার হাত কাঁপছে। আমি ভালো চা
বানাতে পারি। আমার বউ আর মা আমার হাতের চা খেয়ে বিছানা ছাড়ে!
একটা বেলুন সবে মাত্র স্বপ্ন
ভরে উড়তে শুরু করেছিল পলকে তা মাটিতে নেমে এল বিস্ফোরণ নিয়ে আকস্মিক ভাবে অনুভব
করলেন বেদবতী।
-- আপনার শরীর ভালো লাগছে না? চা ভেজাতে ভেজাতে উদ্বিগ্ন
চোখে দেখছে সান্ধ্যদ্বীপ। হ্যালো! কী হল আপনার? ম্যাম!
এই এক রোগ! তার নিজের
চেনাজানা মনটার বাইরে আরেকটা মনের খোঁজ পেয়েছেন তিনি বেশ কয়েক বছর আগে থেকে! এই
মনটা তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। এই মনের দক্ষতা অস্বীকার করার মতো শক্তি তার
নেই যে বুঝতে পারেন।
এক নিমেষে চিন্তার গভীরে ডুবে
গেছেন। আবারও অজান্তেই মন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল! আবারও পরাজিত হয়ে ফিরে আসা
বাস্তবে! এক লহমায় বিষণ্ণতা! খুব দ্রুত সামলে নিয়ে ফিরে এসেছেন বেদবতী নিজের কাছে, বললেন, প্রেশারটা মাঝে মাঝে গণ্ডগোল
করে, মাথা ঘুরে ওঠে তখন। বোধ হয়, সেরকম হল। ও কিছু না। হাসার চেষ্টা করলেন।
সান্ধ্যদীপ হাঁ করে চেয়ে আছে।
বললো, ও কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে দিলেন! মাঝেমাঝেই আপনার
অসুস্থতার খবর পাই। আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আমি আপনার ফলোয়ার!
-- তাই বুঝি?
চা ছাঁকতে ছাঁকতে মৃদু হাসলো
সান্ধ্যদীপ।
-- তোমার বউ আর মা দু’জনেই খুব লাকি। আজকালকার দিনে
এমন ছেলে বিরলই বলবো। তোমার বউ আমার লেখাপত্র পড়ে?
-- না। ও ডাক্তার। ও ওর প্রফেশন সংক্রান্ত জার্নাল ছাড়া কিছু পারে না।
আমার মা তো আপনার ডাই-হার্ড ফ্যান। চায়ে কাপ বেদবতীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললো, মায়ের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা এই জন্য।
সন্ধ্যাতারা উঠেছে পশ্চিম
দিগন্তে। আজ যেন সে অন্যদিনের তুলনায তীব্রতর উজ্জ্বল মনে হল বেদবতীর। আশ্চর্য
লাগছে ছেলেটিকে। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব আছে ছেলেটির মধ্যে। অদ্ভুত আকর্ষণীয়! কথায়
কথায় সন্ধে পেরিয়ে গেছে যে ছেলেটি বুঝতেই দেয়নি!
-- আপনি কিন্তু এই সময়ে এইভাবে গায়ে হালকা গরম কিছু না দিয়ে বসবেন না।
দেওয়ালীর পর থেকেই ঠান্ডাটা পড়েছে কিন্তু এইবার। একটা স্কার্ফ জড়িয়ে রাখবেন।
মুচড়ে উঠল যেন ভেতরটা, মনে হল বেদবতীর। তীব্র মোচড়টা টের পেলেন গভীর কোনো এক স্থানে। একেই
কি তাহলে মধুর প্রদাহ বলে? কত কী লিখেছেন আজ পর্যন্ত! কত
মানুষের কথা! অথচ নিজের অনুভবকে মহাবিশ্বের উপলব্ধি করে সৃষ্টি করতে পারেননি যেন
বারবার মনে হয়। এই সেই অচেনা মনোজগৎ! ব্যাপ্ত ও বৃহত্তর এক জগৎ!
-- হ্যালো! ম্যাম! হে!
এ কী অপ্রস্তুত অবস্থা। বললেন, সান্ধ্যদীপ!
-- হ্যাঁ ম্যাম!
-- তুমি কি বিজ্ঞাপনটা পড়েই এলে? মানে-?
-- হ্যাঁ। বলতে পারেন সাহস পেলাম। আর সেই তেরো বছর বয়স থেকে যে ইচ্ছেটা
একদিনের জন্যেও মন থেকে, মাথা থেকে যায়নি সেই ইচ্ছাটা
এত বছর বাদে হয়তো বা পূর্ণ হবে ভেবে সোজা চলে এলাম।
কী স্পষ্ট দ্বিধাহীন উচ্চারণ
সান্ধ্যদীপের! বিস্মিত বেদবতী। বলেই ফেললেন, কীরকম ইচ্ছা শুনি? বলা যায়?
-- নিশ্চই যায়। পায়ে ওপর পা তুলে দুটো হাত কোলের ওপর আড়াআড়ি রেখে বসলো
সান্ধ্যদীপ। বসার ভীতে এক শান্ত সমাহিত ভাব। বললো, বলবো বলেই তো আসা। আপনার থেকে মাত্র এক হাত দূরত্বে বসে গল্প করছি এত
সহজভাবে, ভাবতে পারিনি কোনোদিন! যেদিন
কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম...? তাকে থামিয়ে দিলেন বেদবতী, বললেন, আমি তো আমার নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন
দিইনি। তাহলে-?
-- আমার এক বান্ধবী আপনার বিজ্ঞাপন পড়ে বক্স নম্বরে জানিয়ে ছিল সে আপনার
গল্প করার সঙ্গী হতে চায়। তাকে নম্বর দেওয়া হয় তখন। সেটাও আপনার পরিচিত ফোন নম্বর
নয়। ও এসেছিল। আপনাকে দেখে ও চমকে গিয়েছিল যে আপনি গল্প করার সঙ্গী  খুঁজছেন
সাম্মানিকের বিনিময়ে কিন্তু আপনি ওকে সিলেক্ট করেননি। আমাকে মহা বিস্ময় নিয়ে
বলেছিল জানেন? আর আমি বিস্মিত হতে গিয়ে
পারিনি, মানে হইনি।
-- কেন? যারাই এসেছিল তারাই চমকে
গয়েছিল আমাকে দেখে। তাদের চোখে রাইটার পোয়েট বেদবতী বর্মন গল্প করার জন্য লোক
খুঁজছেন! আসলে ওই চমকে যাওয়া বা বিস্মিত হয়ে যাওয়াটাই আমার তাদের পছন্দ না করার
কারণ।
-- আমি হইনি, বন্ধুর মুখে আপনার কথা শুনে।
প্রাথমিক একটা ধাক্কা লাগলেও মনে হয়নি এটাই হওয়ার কথা ছিল। না হলে আমার ইচ্ছেটা
পূর্ণ হবে কী করে? তেরো বছরের কিশোর থেকে গতকাল
অবধি-! স্বপ্নটা লালনপালন করেছি! মহাবিশ্ব জানে! দ্য হোল ইউনিভার্স!... আপনি
কিন্তু গায়ে কিছু জড়িয়ে এলেন না! প্লিজ ফর গড সেক।
-- থ্যাংকস। জড়াবো। বলে উঠে গিয়ে লাল-কালো সুতোয় কাজ করা কাশ্মীরি
স্টোলটা গায়ে জড়িয়ে টেরেসে এলেন তখনই বেদবতী। বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভব। এই
অনুভব লোকেই আজ পর্যন্ত ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে পারলেন না যেন তিনি!
-- বিউটিফুল লাগছে আপনাকে! আপনার বিউটিটা না অন্যরকম। কেমন স্নিগ্ধ অথচ
উজ্জ্বল আলোর মতো!
-- থ্যাংক য়ু সান্ধ্যদীপ। তোমার নামটা ভারী চমৎকার। তুমি যেন কীসব
বলছিলে-!
-- বলবো। যদি আপনার গল্প করার বন্ধু হতে পারি নিশ্চয়ই সবটুকু বলবো। না
বলতে পারলে আবার জন্ম নিতে হবে-হাঃ হাঃ হাঃ উচ্চকিত হাসিতে উড়িয়ে দিল কথা সে। আজ
শুধু এইটুকু জানুন অন্তত স্বপ্ন পূরণের পথে আমি। না হলে আপনারও তখন একটা ইচ্ছে হতো
না। আর আমার বন্ধুও ডিসকয়ালিফায়েড হয়ে ফিরে আমাকে বলত না। পেপার কাটিং-টা ওই
দেখিয়েছিল, ইনফ্যাক্ট। গালে হাত দিয়ে
বিস্ময় চোখ নিয়ে দেখছেন বেদবতী। বললেন, ইন্টারেস্টিং!
-- কটা বাজে জানেন? নাইন থার্টি অলমোস্ট। আজ আমি
যাব। আপনি ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়বেন। আই থিংক, আমি সিলেক্টেড। ভ্রু নাচিয়ে
হাসলো সান্ধ্যদীপ।
ঠোঁট জুড়ে বঙ্কিম হাসির রেখা।
বেদবতী ঘাড় নাড়লেন। গল্পে গল্পে সাড়ে নটা! কাল আসছো তো? তুমি কী করো জানা হলো না তো!
-- একটা ছোট্ট বিজনেস আছে। কারুর অধীনে কাজ করা পোষাবে না জানতাম, তাই। বলবো সব। আসবো ছটা নাগাদ। সানসেট দেখতে দেখতে চা খাব। বাই। টেক
কেয়ার। দমকা বাতাসের মতো বেরিয়ে গেল সান্ধ্যদীপ। আর আশ্চর্যের অধিক হয়ে তাকিয়ে
রইলেন বেদবতী।
 
এমনও হতে পারে! এমনও হয়? বুকের মধ্যে শান্ত অথচ উত্তাল ঝড় বেদবতীর। তাহলে কি সান্ধ্যদীপকেই
খুঁজছিলেন তিনি? সান্ধ্যদীপের ছবিই মনের মধ্যে
এঁকে রেখেছিলেন? বিভ্রান্ত বোধ করলেন। অস্থির
লাগছে বড়। টেরেসে এসে পায়চারী করলেন খানিকক্ষণ। চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটা
বাজছে দেখে হাতে নিতেই দেখলেন অচেনা নম্বর! সান্ধ্যদীপের ফোন...! হ্যালো? বলতেই ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর,  খেয়ে নিন। রাত করবেন না। আজ আপনার ঘুম আসবে না চট
করে। কিন্তু ঘুমোতে হবে। বাই। গুডনাইট।
হালকা খাবারে এখন তার নিয়মিত
অভ্যাস। চিকেন সুপ আর ব্রেড টোস্ট খেয়ে শুয়ে পড়লেন বেদবতী যেন কেউ তাকে নির্দেশ
দিয়েছে, এবং তা পালন করতেই হবে তাকে। কত কতদিন বাদে এমন করে
কেউ নির্দেশ করল!
বাতাসে উড়ে যাবে ঘর গেরস্থালী।
দশতলার ঘর ঘুরে বাতাস লুটোপুটি খায়।
স্বপ্ন! স্বপ্ন আসলে কী? চিন্তা? এই যে ভেতর বাহিরে দুটি মন যা
তার আয়ত্তাধীন নয়, তাদের বাস কোথায়? আবছায়া-ছায়া কতগুলো মুখ সরে সরে যাচ্ছে, আসছে একটা ঘোরের মধ্যে দেখতে পেলেন তিনি। আর মস্তিষ্ক জুড়ে কথারা
ছোটাছুটি করছে। এই মুখ তার চেনা নয়। তাহলে তারা আসে কেন?
আচমকাই ঘুমের ঘোর কেটে গেল।
সান্ধ্যদীপের বসে থাকা দেখতে পেলেন। প্রশ্ন! প্রশ্নের পর প্রশ্ন! অবাক করে দিয়েগেছে
সে তাকে। তেরো বছরের বালকের মনে এতটাই রেখাপাত করেছিলেন তিনি! কেন এল সান্ধ্যদীপ? কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার পর থেকে পনেরো দিনের মধ্যে কত ছেলেমেয়ে যে এল!
তাকে দেখবে ভাবতে পারেনি ছেলেমেয়েগুলো। তাই এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল! প্রত্যেকের
এক প্রশ্ন, আপনি! দিদি! আপনি গল্প করার
জন্য বন্ধু-! তারপর আর কথা এগোতে পারেনি। কথায় কথা এগিযে নিয়ে যাবার মতো কারোকে
পেলেনই না!
 
আজ মনের অগোচরেই খানিকটা বেশি
সাজগোজ করে নিলেন বেদবতী। তারপর কী মনে হতে লিপিস্টিক মুছে দেখলেন। শুধুমাত্র ঘন
করে আঁকা ভ্রু! আর তার নীচে অতল দুটো চোখ তার।
দীপা আজ এসেই জেনে নিয়েছে গল্প
করার লোক মনোনীত হয়ে গছে। তাই আজ সান্ধ্য চায়ে সে হালকা জলখাবারও বানিয়েছে সে
নিজেই।
সমস্ত গাছে গাছে, জলের ওপরে, পাহাড় চূড়োয় যখন সন্ধের আলো
পড়ল তখনই এসে পড়ল সান্ধ্যদীপ। এ যেন আসা নয়। আগমন!
-- তারপর? বাহ! কিছু মনে না করলে বলি কী
অপূর্ব লাগছে আপনাকে! জাম রঙের তাঁত! আপনার শরীরের রঙে সে মিশে গেছে! লিপস্টিক
লাগিয়েও মুছে নিয়েছেন! কেন? অবশ্য লিপস্টিকের প্রয়োজন হয়
না আপনার ভরাট ঠোঁট দুটোর।
কী অপ্রস্তুত! কী অপ্রস্তুত!
কী দৃষ্টি ছেলেটার! লিপস্টিক মুছে দিয়েছেন তাও চোখ এড়ায়নি!
কথা বলতে বলতে ঘাড় এলিয়ে
নির্ভার হয়ে বসলো সান্ধ্যদীপ। দৃষ্টি তার মুখের ওপর থেকে সরেনি।
-- কাল রাতে ঘুমোলেন?
-- সত্যি বলবো? না, অনেক চিন্তা মাথায়।
-- আপনার চিন্তা-ভাবনা তো সে অনেক উচ্চ মার্গের। তার নাগাল কি সাধারণ
মানুষ পায়?
-- হয়তো। অথবা এতই সহজ যে সহজ কথাটিই মানুষ সবচেয়ে কম বোঝে!
 -হয়তো!
চায়ের সরঞ্জাম, আর ফিশফ্রাই দিয়ে গেল দীপা। এক ঝলক ভালো করে পরিমাপ করল যে
সান্ধ্যদীপকে সে, তা নজর এড়ায়নি বেদবতীর।
আজ যেন কথা বলার মতো কথা খুঁজে
পাচ্ছে না বেদবতী। চা প্রস্তুত করতে করতে সান্ধ্যদীপই বললো, খুব প্রিয়জন কারোকে মনে হলে অনেক সময় আমরা কথা খুঁজে পাই না। কী
আশ্চর্য্য! ছেলেটা টেলিপ্যাথি জানে না কি? হতবাক বেদবতী।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে
সান্ধ্যদীপ বললো, পৃথিবীতে কত অজানা ঘটে যায়!
ঘটনা! তার এক্সপ্ল্যানেশন হয় না। এই যে সে ছেলেটার স্বপ্ন ছিল একদিন সে আপনার
কাছাকাছি আসবে, এলো তো? আপনার মতো মানুষ গল্প করার লোক খুঁজচেন ভাবা যায়? যার একটা আঙুলের চুটকিতে হাজার নারী-পুরুষ অস্থির হয়ে যায়, সেই মানুষ খুঁজছে গল্প করার লোক! নাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হত কী করে?
অতলস্পর্শী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে
রইলেন বেদবতী।
-- তোমার স্ত্রী জানে যে, তুমি গল্প করতে আসছ?
-- না। মা জানে। মাযের অবস্থা জাস্ট তাকিয়ে দেখা যায় না। হা-হা-হা-।
আমার বউ আমি কী করি, না করি, এসব নিয়ে বদার করে না জাস্ট।
-- ভালো তো।
-- ভালো কী না জানি না! ভালো বললেন কেন?
-- স্পেস দিচ্ছে। বেশিরভাগ সম্পর্কে স্পেস থাকে না বলে অশান্তি হয়।
-- আসলে ঠিক কতটা স্পেশ থাকলে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত টিকে যায় তার পরিমাপ
কে করবে বলুন?
-- আর যু হ্যাপি?
-- ইয়েস। পারমিতাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সম্ভবত ওরও নেই।
-- এক্সট্রা ম্যারিট্যাল অ্যাফেযার সম্বন্ধে তোমার মতামত কী?
-- ম্যারেজ আর ভালোবাসা এক নয়। আপনি তো ভালোবাসা নিয়ে অনেক লিখেছেন।
আপনিই বলুন না? এনি ডেফিনেশন?
-- বিয়ে পরবর্তী সময়ে কখনো আর কারোর প্রেমে পড়েছ?
-- না। আসলে সেই জায়গাটা একজন দখল করে আছে।
-- ওহ! তাহলে তাকে বিয়ে করলে না কেন?
-- তাকে বিযে করা যায় না বলে। সুনীলের নীরাকে কি বিয়ে করা যায়? সে তো মন ছুঁয়ে থেকেও অধরা! আমার রানিও অধরা!
-- ওহ! আসলে কী জানো এই বিষয়টাই জটিল। অধরা বস্তু ধরা দিলেই যেন তার
সবখানি দেখা জানা হয়ে গেল। আর জেনে যাওয়া বিষয়ের ওপর আর কতটাই বা অনুরাগ থাকতে
পারে?
-- তবে দখল করার পরে অধিকার বোধ চলে আসে একটা।
-- সেটা মাপের মধ্যে থাকলে পজিটিভ, নাহলে সর্বনাশ। এক্সট্রা
ম্যারিট্যাল শব্দটার মধ্যেই কিন্তু অনেক কিছু রহস্য খেয়াল করে দেখো। বিবাহ
বহির্ভূত সম্পর্ক! সম্পর্ক হলেই কি বিয়ে হয় না করা যায়? তার মানে বিয়ে গণ্ডীর মধ্যে এসেই সম্পর্ক গৃহবন্দী?
-- রাইট। আপনি কী মনে করেন?
-- আমার তো এ নিয়ে কত কাব্যনাটক! ব্যক্তিগতভাবে আমি এমনটা পছন্দ করিনি
বলেই বারবার বিয়ে করেছি।
-- আমি আপনার কতটা গভীরে পৌছে গেলাম, দেখলেন?
-- তা কী অত সহজ সান্ধ্যপ্রদীপ?
-- নয় বলছেন? তাহলে আমি যে তেরো বছর বয়স
থেকে আপনার মধ্যে যাপন করতে করতে আজকের আমি হয়ে উঠলাম! আপনার আর আমার মধ্যে দূরত্ব
কোনোদিনই ছিল না। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে কেমন সাহিত্যের ভাষায় কথা বলছি দেখছেন? সে কি এমনি? হা-হা-হা-হা।
চায়ের পেয়ালা শেষ হয়ে গেছে, তলানীটুকু নিঙড়ে পান করল সান্ধ্যপ্রদীপ। তারপর বললো, আমার প্রথম কবিতা লেখা আপনাকে দেখার পর। আমার জীবনবোধ মানে তেরো বছর
বয়সের সদ্য কিশোর তার চারপাশের বন্ধুদের তুলনায় অনেক পরিণত চিন্তার হয়ে গেল
রাতারাতি। আমার প্রথম ম্যাস্টারবেসন আপনাকে কল্পনা করে। স্যরি। খারাপ ভাববেন না।
আপনাকে অপমান করছি না। রিয়ালিটিটুকুই বলে ফেললাম।
সপাটে ধাক্কা খেলেন বেদবতী। এত
স্পষ্ট সত্য বলতে কোথাও আটকালো না ছেলেটির! স্পষ্ট ও সত্য বলার জন্য বিখ্যাত তিনি।
সাহসী বলে খ্যাত। তবু জীবনে সব সত্য কি ধারণ করা যায়? আশ্চর্য লাগছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না তিনি।
-- আপনার অস্বস্তি হচ্ছে? আনইজি ফিল করছেন? আপনার কাছ থেকে তো এটা এক্সপেকটেড ছিল না। আপনি আমার কাছে পরিচিত
ছকের বাইরে একজন মানুষ। তেরো বছরের কিশোর যে ম্যাস্টরবেট করে তা আপনি জানেন।
অ্যাবনর্মাল কিছু নয়। আর সেটা কারোকে ইমাজিন করেই করে। আমি পাপ ভাবতাম। অন্যায়
ভাবতাম। চাপা স্বভাবের ছিলাম তাই। লিভ ইট।
-- লিভ ইট কেন? নিজের কণ্ঠস্বর যেন নিজের কাছে
অপরিচিত মনে হল বেদবতীর।
-- কারণ আপনি সত্যটা গ্রহণ করতে পারছেন না। আপনি অনেক সাহসী লেখা লিখলেও
ব্যক্তিগত জীবনকে সম্ভ্রম দিতে চেয়েছেন। শুধু, আজ বুঝলাম। মানুষ এত দ্বিচারণ
করে কেন বেদবতী?
মাথা ঝুঁকে আসছে বেদবতীর।
নিজেকে পাঠ করার পরেও সম্পূর্ণ পাঠ করা হয়নি বুঝতে পারছেন।
-- যেদিন আপনাকে প্রথম দেখলাম সেই দিনটা যে কী ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে উঠেছিল
আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। সারারাত ঘুম নেই! শুধু আপনার মুখ! আপনার কথাবলা
পশ্চার আমার মাথার ভেতরে! আমার স্কুলেও অনেক মেয়ে খুবই সুন্দরী। কিন্তু আপনি তো
ভিসুভিয়াস! আপনার মুখ, শরীর আমাকে উত্তেজিত করছিল। ২৬
মার্চ; দিনটাও ভুলিনি দেখুন, আমার মন থকে পাপবোধ, অন্যায়বোধ একেবারে ভেঙে চুরমার
হয়ে গেল সুন্দরের কাছে। ওই দিনের আগে আমি ম্যাস্টরবেট করতাম না। সেলফ সিক্রেশন হয়ে
যেত। এত সুন্দর একটা অনুভতি আপনি আমাকে গিফট করেছিলেন তার জন্য টিল ডেথ আমি কৃতজ্ঞ
থাকবো। দ্যাট ডে আই বিকাম আ ম্যান। আমি আপনাকে আগলে রাখতাম! আচমকাই ইষৎ ডান দিকে
ঘুরে পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারার দিকে তাকাল সে। কয়েকটি নিমেষ মাত্র! ফিরে তাকাল
বেদবতীর দিকে, বললো, ধ্রুবতারাটা দেখছেন? ঠিক ওইরকম সত্যি! ধ্রুব সত্যি!
ভাবছেন তো, বোকা বোকা ইডিয়টিক নাটক করছি?
-- মনে করছি না। আমি আসলে...। কথা হারিয়ে ফেললেন বেদবতী। এত সৎ সাহসী
স্বীকারোক্তির সামনে তিনি এই প্রথম! অথচ জীবনকে তছনছ করে দেখার অভিজ্ঞতা তার জীবন
জুড়ে!
-- বেদবতী! জানেন আপনাকে আমি আমার জগতে অন্য একটা নামে ডাকি সেই দিন
থেকে! শুকতারা!
সমুদ্র মন্থন হচ্ছে যেন সমস্ত
শরীর ঘুরে বেদবতীর। উথালপাথাল! এই মন্থন থেকে কী উঠে আসবে তিনি জানেন না! গরল অথবা
অমৃত! নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছেন। তবু সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে!
-- তোমার লভ ম্যারেজ?
-- সেমি বলতে পারেন। মায়ের পছন্দ করা ছাত্রী, আমারও ভালো লেগে গেল। মায়ের স্কুলে পড়ত।
-- কী নাম?
-- দমযন্তী গর্গ। ওই পর্ব আমাদের কথায় আসবে না। সি ইজ আ পার্ট অব মাই
লাইফ ওনলি। যেমন আমার দুটো হাত আছে সেইরকম। গ্যাংরিন না হলে কাটা যাবে না।
-- সুন্দর কথা বলো তুমি।
-- আপনার থেকে শেখা, ম্যাম! আপনার সমস্ত অনুষ্ঠানে
আমি যেতাম এবং যাই। টেলিভিশনে দেখি। সব লেখা পড়ি।
-- থ্যাংকস।
উত্তেজিত হয়ে উঠল
সান্ধ্যপ্রদীপ। না, নো-। থ্যাংকস দিয়ে ডিসটেন্স
বাড়াবেন না প্লিজ। আপনি আমার হাত-পা বডি নন। আপনি আমার দুর্লভ স্বপ্ন যাকে রোজ
জন্ম দিই আমি। নো, আমি নাটক করছি না। নাটকীয়
লাগছে অতি মাত্রায় আমি জানি।
-- এত ভালোবাসা! এটা ইনফ্যাচুয়েশন! দেয়ার ইজ নো লভ অ্যাট অল ইন দিজ
ওয়র্ল্ড! ওই যে স্বপ্ন বললে...! দূরত্ব আর অজানার একটা আকর্ষণ চিরন্তন। কাছে এলেই
তা আগ্রহ হারায় দীপ।
-- এত বছর ধরে যদি একটা ইনফ্যাচুয়েশনকেই ভালোবাসতে পারি তাহলে ওটাই
ভালোবাসা, শুকতারা।
-- আজ যদি বলি রাতটা থেকে যাও, পারবে?
-- পারবো। মাকে একটা কল করে শুধু জানিয়ে দেব।
-- বউকে?
-- ও এইসব ব্যাপারে অত বদার করে না। মা জানিয়ে দেবে। ও হায়ার ডিগ্রির
জন্য সারাদিন বড়বড় মেডিকেল য়ুনিভার্সিটিলোতে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
মাথা নাড়লেন বেদবতী, ও। তোমারও তো আশ্চর্য লেগেছিল যখন জানলে আমিই গল্প করার সঙ্গী
খুঁজছি। আসলে জীবনে এত কিছু দেখা হয়ে যাবার পরে ও মনে হচ্ছিল কিছু বাকি আছে। এখনো
হয়নি এগোনো! ঠোঁটের রেখায় রেখায় অদ্ভুত হাসির ছায়া বেদবতীর। দৃষ্টি গভীর অতলান্ত!
আমার যুদ্ধের গল্পগুলো জানো? আমাকে সৃষ্টিকর্তা একজন সেনানী
করে পাঠিয়েছেন। ব্যাটল কিন্তুই যার ঘরবাড়ি।
-- আমি কিচু জানি। হাওয়ায় ভাসে।
-- তার অর্ধেক মিথ্যে। আমাকে সিংহাসন থেকে টেনে নামানোর প্রয়াস।
-- আমি বুঝি।
-- গল্প করার সঙ্গী খুঁজছিলাম, তার গল্প শুনবো বলে। চেনা
পরিচিত জগৎ থেকে নির্বাসন নইয়েছি। আমি মানুষের সঙ্গ চেয়েছি অথচ পেয়েছি মুখোশের
সঙ্গ। আমার কথা বলবো বলে কারোকে খুঁজিনি। কিন্তু তোমার মতো আশ্চর্য মানুষের দেখা
পাব ভাবিনি। যখন বেঁচে থাকার জন্য কারণগুলো মরে যায় অথবা হয়তো আর কারণগুলোই নেই
হয়ে যায়, তখন মানুষ জীবন্মৃত হয়ে যায়!
ডিপ্রেশন আসে। সুইসাইড করে। কোথাও পালাতে চায় অথচ কোথায় পালাবে? আমার বেঁচে থাকার জন্য কারণগুলো নেই হয়ে আসছিল। উপলব্ধি করছিলাম। অথচ
মৃত্যু আমার কাম্য নয়। নিজেকে হতাশাগ্রস্থ মানুষ ভাবতেই পারি না!
-- আমরা কি আবার একবার গলা ভেজাতে পারি? চা চাই চা চাই? করচে কেউ! হাসলো
সান্ধ্যপ্রদীপ।
-- দীপা চলে গেছে। তাহলে তোমাকেই-। এই যে দীপা, ও নিজেও ভালোবাসা অ-ভালোবাসার খোঁজে আছে জেনে যে অবাক হয়েছি আমি।
স্বামীকে ভালোবাসে কী না বুঝতে পারছে না! কী জ্বালাতন বলো? কজন এভাবে ভাবতে পারে?
-- বাহ!
-- যতদিন না ও শিওর হচ্ছে এই ব্যাপারে বাচ্চা নেবে না। কী স্বাধীন
স্বাভাবিক অথচ সামাজিকভাবে অস্বাভাবিক চিন্তা! তার মানে ওর জন্যেও নির্ধারিত আছে
ব্যাটল্ ফিল্ড! নিজেকে চিনতে পারা চরম দুঃখ বয়ে আনে, জানবে।
-- জানি। আজ অবধি পেয়ে আসছি তাই। আপনাকে যখন নগ্ন করে দেখি, উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে সান্ধ্যপ্রদীপের, তখন বিষাদমাখা এক আনন্দ পাই। একদিকে পুলকিত অন্যদিকে বিষাদ!
অর্গাজমের মতো! সেই তেরো বছর বয়স থেকে পেয়ে আসচি এই দুঃখ আর আনন্দ! নিজেকে চিনেছি।
দমইয়ন্তীর সঙ্গে ইন্টারকোর্স হয় কিন্তু সঙ্গম হয় না!ইজাকুলেশন হয়, অর্গাজম হয় না।
লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেন বেদবতী
সাময়িক। এত সত্য যেন সহ্য করা যায় না। বললেন, চা খাবে বললে? বাঙালিদের এই এক দোষ সব খাই আমরা। চায়ে তো পিতে হ্যায়, হ্যায় না? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে
ফেললেন।
-- আপনাকে যত দেখি ততো অবাক হই, জানেন? তুমি আছো জেনে আমি অন্ধকার ভালো ভেবে যে অতীত আর যেই শীত ক্লান্তিহীন
কাটায়েছিলাম,
তাই শুধু কাটায়েছি!
কাটায়ে জেনেছি এই-ই শূন্যতা, তবু হৃদয়ে কাচে ছিলো অন্য-কোনো নাম।
বলুন তো কে?
-- জীবনানন্দ ছাড়া জীবনকে আর এভাবে দেখেছে কে?
-- জল গরম করে আনি।
 
এই নিয়ে তৃতীয় পেয়ালা চা।
মাথার ওপরে ভেসে যাচ্ছে মেঘ আর ক্ষীণ জ্যোৎস্না। অর্ডার দিয়ে আনানো খাবারগুলো চেয়ে
আছে।
-- কথা বলার মানুষ খুঁজেছি যে কত! তিন তিনবার বিয়ে করলাম। শুধু কথা বলার
জন্য বুঝলে? অতঃপর বুঝলাম ভাষা, কথা আসলে কিছুই নয়। আমরা কথা বলি এক মানুষ তার অর্থ করে আরেক! তুমি
কি জানো আমরা কথা না বলেও কমিউনিকেট করতে পারি শুধুমাত্র ভাইব্রেশন দিয়ে
-- আমি জানি। আপনার সঙ্গে আমার কথা হয় এইভাবেই।
-- আর আমি গাছপালা পশুপাখিদের সে কথা বলি এইভাবে।
-- আপনার বিয়ে ভাঙার খবর জানার পর ডিপ্রেশন আসতো আমার মধ্যে! আপনাকে কেউ
কষ্ট দিচ্ছে আমি সহ্য করতে পারি না!
-- সম্পর্ক যে আসলে কী! যাদের ভালোবেসে বিয়ে করলাম দেখলাম ভালোবাসাই
নেই! ভালোবাসা আসলে যে কী বস্তু!
-- মাথায় শাড়ির আঁচলটা জড়িয়ে নিন। হিম পড়বে। আজ তো সারারাত গল্প করব।
কালকের থেকে হয়তো আপনি আর আমার সে কথা নাও বলতে পারেন? মস্তিষ্কের কোনো এক গভীর অলিন্দে ঠিক এই চিন্তাটাই যে এসেছিল এক
লহমার জন্য! সান্ধ্যপ্রদীপ তা জেনে গেল কী করে? ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠল বুকের
ভেতরে। তিনি বললেন, কেন বললে এমন কথা?
-- এতলো বছর ধরে আমি কিন্তু আপনার সেই যাপন করছি, ভুলে যাচ্ছেন! তেরো বছরের নিষ্পাপ কিশোর যাকে একমাত্র নিজের বলে মনে
করে তার অজানা কিছু থাকে কি?
-- তুমি আমাকে পেতে চাও না? কণ্ঠস্বর ভেঙে চুরে গেল
বেদবতীর। এ কথা তো তার নিজের কথা নয়! এই কথা বার বার শোনা কথা। পেতে চাওয়া! শেষ
পর্যন্ত কী পাওয়া যায়?
কাবাবের একটা টুকরো জিভে ছুঁয়ে
দিয়েছে তখন সান্ধ্যপ্রদীপ। উত্তর দিতে মুহূর্ত নষ্ট হলো না, বললো, আমার চেয়ে বেশি তোমাকে কে
পেয়েছে? হে ম্যাম! পেতে চাওযা মানে কী? বিছানায় ন্যাংটো করে ইন্টারকোর্স করা? তারপর? শেষ? হুঁ? তারপর-?
সমুদ্র মন্থন হে। বেদবতী বললেন, তারপর সমস্ত বিছানা ও রাত্রি জুড়ে পরস্পর থেকে নিষ্ঠুর বিচ্ছিন্ন
হওয়া এক বাস্তব যা দিনের পর দিন আমাদের দূরত্ব বাড়ায় শুধু! বাড়িযে চলে!
-- তাহলে কী পাওয়া হল?
-- শূন্যতা!
-- অথচ আমার মধ্যে শূন্যতা নেই! সেই তেরো বছর বয়স থেকেই পূর্ণ! জানতাম, একদিন তোমার মুখোমুখি হয়ে এই সত্যটা বলতে হবে। শুধু জানতাম না, কবে হবে। কীভাবে হবে? তোমাকে আমি কীভাবে রক্তমাংস আর
স্বপ্ন দিযে তছনছ করে ভাঙি, গড়ি, তোমার মধ্যে আমার আমিত্ব ভেসে যায়, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
নাগরিক কোলাহল কখন যেন
নিদ্রিত! রাতের গভীরতার মধ্যে ডুবে গেছে পৃথিবী! রাতচরা পাখিরা আকাশ জুড়ে। চাঁদের
আলো ঝিম ধরে গেছে! সমস্ত টেরেস জুড়ে শুধু শরীরী নিঃশ্বাস!
পোশাকের আবরণ উন্মুক্ত হতে
চাইছে শরীর। এখনো প্রবল শরীরবোধ আছে শরীরের প্রতিটি কোষে তার উত্তুঙ্গ গান! অথচ
শরীর তো তার আর জাগতো না বহু বছর! যে সকল কারণের জন্য বেঁচে থাকা যায় তার অন্যতম
ছিল শরীর! শরীর তো তার মৃতই কবে!
শরীরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা অন্য
মানুষ বলে উঠল, বেঁচে থাকার জন্য অনেকগুলো
কারণ আছে। তার মধ্যে আজকের এই রাত ইম্পরট্যান্ট।
বেশ কিছুটা সময নির্বাক রইল
সময়! আকাশের দিকে চেয়ে শূন্য দৃষ্টি বেদবতী। টেরেসে পায়চারী করছে সান্ধ্যপ্রদীপ।
মহাকাশের নীচে দুজন মানব-মানবী সম্পর্কের রহস্য খুঁজছে যে যার নিজের মতো করে।
শরীরের উত্তেজনা থেমে গেছে
বেদবতীর। তাহলে এই কি ভালোবাসা? যেন একটি গভীর গাঢ় সম-স্নান
সেরে উঠলেন এই মাহেন্দ্রক্ষণে, তেমনই অনুভব প্রবল হল। মনে হল, এমন পরিপূর্ণতা কি কোনোদিনও অনুভব করেছেন তিনি আগে কখনোও? কী এক অস্থিরতা ক্রমাগত ছুটিয়ে বেড়িয়েছে তাকে! অনবরত!
-- সুখ কী প্রদীপ? তোমার থেকে জানতে চাইছি, বলো। পায়চারী করা থামিয়ে বেদবতীর চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়াল
সান্ধ্যপ্রদীপ। দুটো হাত দিয়ে চেয়ার ধরে এক মুহূর্ত না ভেবে বললো, গভীর মধ্যরাতে দুই নারী পুরুষ কেউ কারোকে না ছুঁযে শারীরিকভাবে
স্পর্শ না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারা। তারা জানে তারা দুজনে দুজনকে
গভীরভাবে ছুঁয়ে আছে, সেই অনন্ত সময় ধরে। তাদের
হারানোর কিছু নেই! ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছেন বেদবতী, হয়তো! হয়তো! হয়তো না, এটাই ঠিক।
-- আপনার মতে সুখ কী?
-- হয়তো বয়সটা তেরো ছিল-! সময়কে পেরিয়ে যেতে পারলে হয়তো দেখবো আসলে
বয়সের ক্রমাংক শূন্য! ভালোবাসা সময় উত্তীর্ণ এক অনুভব, আজ বুঝতে পারছি। যখন আমি প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছিলাম, ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসা, বিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকেছিল, শুধু মনে হত এর চেয়ে আমার মৃত্যু ভালো? কতবার আত্মহত্যা ইশারা করেছে জানো না! আত্মহত্যার পর আমার মৃতদেহটা
দেখতে পেতাম। তারপরেও বেঁচে থাকার কারণ খুঁজেছি! আবার গান লিখেছি, কবিতা, নাটক, গল্প, কাঠ খোদাই করে মূর্তি গড়েছি আর
বেঁচে থেকেছি। আর মনে হয়েছে, কেন বেঁচে আছি? হ্যাঁ? কেন? কেউ তো আমায় ভালোবাসে না! তাহলে? মুখ কী কোনোদিনও বুঝিনি! অথচ
তখন একজন আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসছে একা একাই! কী আশ্চর্য! একটু সময় নিলেন বেদবতী, চেয়ার ছেড়ে উঠে টেরেসে সযত্নে মালতি ফুলগাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন।
কামিনী ফুটেছে গাছ জুড়ে। তার গাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ওরা জানে সব। ওদের সব বলতাম। মেয়েদের অর্গাজম দেরীতে হয়, জানো নিশ্চই? আমার আমার কোনেদিনও হয়নি!
অর্গাজম কী আমি জানিই না! শুনেছি দেরীতে হয়। সময় লাগে। দারুণ একটা ফুলফিলমেন্টের
অনুভব হয় সারা শরীর জুড়ে! স্বর্গীয় অনুভতি! কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন
বেদবতী। এক ফালি চাঁদটা সম্পূর্ণ ঘুমন্ত এখন। যতদূর দেখা যায় গাঢ় তন্দ্রাছন্ন
প্রকৃতি। নিজের চেয়ারে এসে পা মুড়ে বসলেন, বললেন, আজ আমার অর্গাজমের ফিলিংস হে, দীপ। জাস্ট আশ্চর্য একটা
স্বর্গীয় আনন্দে মরে যেতে ইছে করছে। এটাই তো অর্গাজমের ফিলিংস! তাই, না? এটাই তো সুখ!  এটাই তো সুখ। আহ! কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার! কী আনন্দ!
-- এটাই সুখ। আমারও হয়। আমি এতটাই সম্পূর্ণভাবে তোমাতে... খ্যয়র ছোড়ো, ও সবকুছ কহনে কী বাত হি নহী!
-- একটা অর্গাজমের পর আর কিছু পাবার থাকে?
না বোধ হয়! শুধু অনন্ত সুখে
ভেসে যাওয়া ছাড়া! তোমার স্ত্রী... ও কি সুখী?
-- সেখানেও তো তুমি। আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কারোকে কিছু করিনি! আমাকে
খারাপ ভাবলে ভাবতে পারো। ওর শরীরে আমি তো তোমাকেই পেয়ছি!
সেই কিশোরীবেলার মতো আশ্চর্য
চোখে তাকালেন বেদবতী। যেন এমনটাও হয়? হয়?
উত্তেজিত হয়ে পায়চারী করলো
কিছুক্ষণ সান্ধ্যপ্রদীপ। পায়চারী করতে করতেই বললো, তুমি কি আমাকে আসতে বারণ করে দেবে এরপর? দিলেও অসুবিধা নেই।
খুব ধীরে মাথা নাড়ছেন বেদবতী, না, না তো।
-- বললেন না?
-- আবার আপনি আজ্ঞে কেন?
-- ঠিক আছে। বললে না তো?
-- না। তবে কী জানো? আমি নিজেকে বড় একটা চিনি না
বোধ হয়। একা থাকতে থাকতে, থাকতে থাকতে একাকীত্বই আমার
প্রেম! আজ থেকে তুমি এলে। একাকীত্বর সে একটা সংঘাত হবে তোমার উপস্থিতির। তবে তুমি
আসবে। আমি ডাকি আর না ডাকি তুমি তো সেই কোন্ এক অজানা কাল থেকে আমাকে সে নিয়ে
বেড়াচ্ছ! আমরা তো এক পক্ষকাল জোছনার জন্য অপেক্ষা করি। তারপর সে আসে। আমরা কী আদরে
বরণ করি তাকে! গায়ে মাখি। মুখে মাখি। জোছনার শরীরে মিশে যাই! সেও এক অর্গাজম বটে!
তুমি তেমনই এসো। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেও তুমি এসো। চলে যেওনা। শিশুর মতো
হাসলেন বেদবতী। বললেন, কাল আরেকটা অন্য গল্প নিয়ে
আসবে?
বেদবতীঃ চোখের ওপর পূর্ণ দৃষ্টিপাত করলো সান্ধ্যপ্রদীপ। নির্মিমেস
তাকিয়ে খুব জোরে জোরে মাথ নাড়ছে। বললো, আরো সত্যি গল্প নিয়ে আসব। লভ
যু। তোমার পায়ের তলায় বসে তোমার একটা ছবি আঁকবো কাল। ছবি আঁকতেও  তোমার মুখ
প্রেরণা ছিল! তোমার মুখ আঁকতে আঁকতে বিজ্ঞানের ছেলেটা ছবি আঁকতে ভালোবেসেছিল! এটাও
সত্যি গল্প।

Comments
Post a Comment